
ফাইল ছবি
নজিরবিহীন এক আইনি পদক্ষেপে, সমন্বিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মহাপরিকল্পনা (আইইপিএমপি) ২০২৩-কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে রিট করেছেন একদল আইনজীবী, ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসান, অ্যাডভোকেট আবদুল্লাহ আল নোমান, অ্যাডভোকেট মনিরা হক মনি, অ্যাডভোকেট শিমন রায়হান।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই প্রথম এ ধরণের কোনো মামলা হল, যাকে জলবায়ু ন্যায্যতার পথে ঐতিহাসিক এক পদক্ষেপ হিসেবেও বিবেচনা করা হচ্ছে। জ্বালানি নিরাপত্তা ও পরিবেশ সুরক্ষার পক্ষে কাজ করে যাওয়া সামাজিক উদ্যোগ ল’ইয়ারস ফর এনার্জি এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের (লিড) নেতৃত্বে এই রিট পিটিশন দায়ের করা হয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর সরকারের ক্রমাগত নির্ভরতা এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতাকে চ্যালেঞ্জ করার লক্ষ্যেই এই আইনজীবীরা সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন।
রিটের প্রাথমিক শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারপতি ফাহমিদা কাদের এবং বিচারপতি মুবিনা আসাফ রুল জারি করে কেন জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা (এমসিপিপি) ২০২২-২০৪১ দেশের মূল জ্বালানি নীতিতে থাকবে না এবং কেন আইইপিএমপি ২০২৩ বাতিল হবে না, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কারণ দর্শাতে বলেছেন।
রিটকারীরা বলছেন, বাংলাদেশ যেন স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিতে দেওয়া সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি পূরণে সচেষ্ট হয় এবং প্যারিস চুক্তি ও জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) মতো জলবায়ু সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোর বাধ্যবাধকতা মেনে চলে তা নিশ্চিত করাই তাদের এই আইনি পদক্ষেপের লক্ষ্য।
বিশ্বব্যাপী নাগরিকরা জলবায়ু ইস্যুতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে অনন্য সাধারণ বেশকিছু মামলা দায়ের করেছেন, লিডের নেতৃত্বে হওয়া রিটও তারই প্রতিফলন। সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার শিশুরা তাদের সরকারের জলবায়ু নীতির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের পথে হেঁটেছে। লিডের এই রিটকে দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে, জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় অকার্যকর সরকারগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতেও একে একটি অবিস্মরণীয় নজির হিসেবে দেখা হচ্ছে।
পিটিশনকারীদের ভাষ্য, কয়লা ও এলএনজির (৩০.৭%) মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর অতি নির্ভরশীল আইইপিএমপি ২০৫০ সালের মধ্যে তরল হাইড্রোজেন ও অ্যামানিয়ার (৩২.৮%) মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দিকেও ঝুঁকবে, যা বাংলাদেশের জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনাতে বাংলাদেশ ২০৫০ সালের মধ্য শতভাগ নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে পৌঁছাবে এমন অঙ্গীকার করা হয়েছে।
পরিবেশবাদী এই আইনজীবীরা জোর দিয়ে বলছেন, আইইপিএমপি পরিবেশ সুরক্ষা আইনের একাধিক ধারা এবং এর পাশাপাশি বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অধিকারে জোর দেওয়া বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮এ ধারার মূল চেতনা লঙ্ঘন করছে। এই জ্বালানি মহাপরিকল্পনাটি জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা অব্যাহত রেখেছে, যা পরিবেশের স্থায়িত্ব ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি; কেননা, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গত গ্যাসই জলবায়ু পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি, এ কারণে বন্যা, সাইক্লোন, খরার মতো চরম আবহাওয়াজনিত ঘটনার মাত্রা ও পরিমাণ বাড়ছে- যেসব চ্যালেঞ্জের সামনে বাংলাদেশ বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।
হাইড্রোজেন ও অ্যামোনিয়া কো-ফায়ারিংয়ের মতো অপ্রমাণিত প্রযুক্তির ওপর আইইপিএমপি-র নির্ভরশীলতাও উদ্বেগ বাড়াচ্ছে, মহাপরিকল্পনাটির অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। এই জ্বালানি পরিকল্পনাটি প্রস্তুতে অপ্রকাশিত বাজেট এবং বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদের না রাখাসহ স্বচ্ছতার নানান ঘাটতি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। টেকসই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা বিকাশের লক্ষ্যে প্যারিস চুক্তি ও ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম ভিশনের মতো যেসব আন্তর্জাতিক চুক্তি রয়েছে আইইপি এমপির দৃষ্টিভঙ্গিও সেগুলোর সঙ্গে যায় না।
এর বিপরীতে, এমসিপিপি নবায়নযোগ্য শক্তি ও পরিবেশ সুরক্ষাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে, যা আইন এবং সাংবিধানিক নীতিমালার সঙ্গে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনায় তৃণমূল পর্যায়ে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদক থেকে শুরু করে নানান খাতের অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, নবায়নযোগ্য প্রকল্পগুলোতে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও আর্থিক প্রতিশ্রুতিকে।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি (জাইকা) বাংলাদেশের বিদ্যুৎ- জ্বালানি সংক্রান্ত নানান প্রকল্পে অর্থ দিয়েছে, কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি ভিত্তিক উদ্যোগেও তাদের অর্থায়ন আছে, যা বৈশ্বিক জলবায়ু সুরক্ষায় দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা নিয়ে দুর্ভাবনা বাড়াচ্ছে। এমসিপিপি চাইছে নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্পগুলোতে আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়ে আসতে, জোর দিচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরশীলতা থেকে সরে যেতে, যাকে বৈশ্বিক জলবায়ু সুরক্ষায় নেওয়া পদক্ষেপ বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতি হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
সারাদিনের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল প্লে স্টোর এবং অ্যাপল অ্যাপ স্টোর থেকে ডাউনলোড করুন চ্যানেল 24 অ্যাপ-
এফএইচ